নাকবা ১৯৪৮: ফিলিস্তিনি বিপর্যয়ের ইতিহাস, অর্থ, এবং এর বর্তমান প্রভাব।
"নাকবা" (আরবি: النكبة), অর্থাৎ "বিপর্যয়", ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় ফিলিস্তিনি জনগণের উপর সংঘটিত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা ৭৫০,০০০-এরও বেশি মানুষকে তাদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করে এবং ৫৩০টিরও বেশি গ্রাম ধ্বংস করে। এটি আধুনিক বিশ্বের দীর্ঘতম শরণার্থী সংকটের সূচনা করে। ২০২৫ সালে, নাকবার ৭৭তম বার্ষিকীতে, এটি শুধু একটি অতীত ঘটনা নয়, বরং দখলদারিত্ব, অবরোধ, এবং জমি হারানোর মাধ্যমে চলমান একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। এই গবেষণাপত্রে নাকবার ঐতিহাসিক পটভূমি, ঘটনাপ্রবাহ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ঐতিহাসিক বিতর্ক, এবং ২০২৫ পর্যন্ত এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে।![]() |
© AFP |
১. ভূমিকা
নাকবা ফিলিস্তিনি জাতীয় পরিচয়ের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান। ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী মিলিশিয়া কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং ১৯১৭ সালের বালফোর ঘোষণা থেকে শুরু হওয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। ২০২৫ সালে, ফিলিস্তিনিরা এখনো গাজায় অবরোধ, পশ্চিম তীরে সংযুক্তিকরণের হুমকি, এবং জেরুজালেমে বাড়ি হারানোর মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই গবেষণার উদ্দেশ্য হলো নাকবার পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা এবং এর চলমান প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা।
২. ঐতিহাসিক পটভূমি
নাকবার শিকড় ১৯ শতকের শেষে জায়নবাদী আন্দোলনে রয়েছে, তবে এর সরাসরি সূচনা ১৯১৭ সালে বালফোর ঘোষণার মাধ্যমে। ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে "ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় আবাস" প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়, যখন ইহুদিরা জনসংখ্যার মাত্র ১০% ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) ওটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটেন ১৯২৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ম্যান্ডেট শাসন চালায়।
২.১ ইহুদি অভিবাসন: ৬০,০০০ থেকে ৭০০,০০০-এ বৃদ্ধি
ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শাসনকালে (১৯২৩-১৯৪৮) ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা নাকবার পটভূমি তৈরি করে। ১৯১৭ সালের বালফোর ঘোষণার পর ব্রিটিশ সরকার ইউরোপীয় ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আসতে উৎসাহিত করে। ১৯২০-এর দশকের শুরুতে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৬০,০০০, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০%। তবে, ব্রিটিশ নীতির সমর্থনে এবং জায়নবাদী আন্দোলনের প্রচারণার ফলে এই সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
![]() |
© IWM (HU 69908) |
১৯৩০-এর দশকে, বিশেষ করে নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি নিপীড়ন বৃদ্ধির পর, অভিবাসন তীব্র হয়। ব্রিটেন বার্ষিক অভিবাসন কোটা নির্ধারণ করে, যা ১৯৩৯ সালের "শ্বেতপত্র" (White Paper)-এ ৭৫,০০০-এ সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। তবে, আইনি ও অবৈধ উভয় পথে ইহুদি অভিবাসন অব্যাহত থাকে। ১৯৪৮ সাল নাগাদ ইহুদি জনসংখ্যা ৭০০,০০০-এ পৌঁছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হয়ে ওঠে। এই অভিবাসন জায়নবাদীদের জন্য জনসংখ্যাগত ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে, যা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে। ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি জমি হারানো এবং জনসংখ্যাগত ভারসাম্যের ক্ষতির সূচনা করে।
এই অভিবাসন শুধু সংখ্যাগত বৃদ্ধি ছিল না; এটি জায়নবাদীদের জমি ক্রয় ও বসতি স্থাপনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি অর্থনীতি ও সমাজের উপর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, জুইশ ন্যাশনাল ফান্ড (JNF) ফিলিস্তিনি জমি ক্রয় করে ইহুদি বসতি প্রতিষ্ঠা করে, যা ফিলিস্তিনি কৃষকদের জন্য জীবিকা হারানোর কারণ হয়। এই প্রক্রিয়া নাকবার পূর্বে উত্তেজনা বাড়ায় এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের ভিত্তি তৈরি করে।
২.২ জায়নবাদী সশস্ত্রীকরণ: হাগানা, ইরগুন, এবং লেহির মতো গোষ্ঠী প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত
ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে জায়নবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর গঠন ও শক্তিশালীকরণ নাকবার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত ছিল। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
![]() |
© AFP/Getty Images |
- হাগানা: এটি ছিল জায়নবাদীদের প্রধান সামরিক সংগঠন, যা ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে হাগানাকে ইহুদি বসতি রক্ষার জন্য অনুমোদন দেয়। সময়ের সাথে এটি একটি সুসংগঠিত আধা-সামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়, যা "প্ল্যান ডালেত" বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা পালন করে। হাগানা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং অস্ত্র সংগ্রহ করে।
- ইরগুন: ১৯৩১ সালে হাগানা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গঠিত এই গোষ্ঠী আরও উগ্র নীতি গ্রহণ করে। ইরগুন ফিলিস্তিনি গ্রাম ও ব্রিটিশ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। ডেইর ইয়াসিন গণহত্যায় এর ভূমিকা কুখ্যাত। এটি গোপনে অস্ত্র আমদানি করে এবং গেরিলা যুদ্ধে দক্ষতা অর্জন করে।
- লেহি (স্টার্ন গ্যাং): ১৯৪০ সালে গঠিত এই গোষ্ঠী আরও চরমপন্থী ছিল। এটি ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের হত্যা এবং ফিলিস্তিনি বিরোধী হামলায় জড়িত ছিল। লেহি ডেইর ইয়াসিনে ইরগুনের সাথে যৌথভাবে কাজ করে।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে এই গোষ্ঠীগুলোকে ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ দমনে ব্যবহার করে। ১৯৩০-এর দশকে হাগানার সদস্যরা ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫) ব্রিটেন জায়নবাদীদের সাথে সহযোগিতা বাড়ায়, যা তাদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ১৯৪৮ সালে এই গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)-এর ভিত্তি হয়ে ওঠে। এই সশস্ত্রীকরণ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নাকবার সময় ব্যাপক সহিংসতা সম্ভব করে।
২.৩ ফিলিস্তিনি দমন: ১৯৩৬-৩৯ সালের আরব বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন
ইহুদি অভিবাসন ও জায়নবাদী সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ১৯৩৬-৩৯ সালের আরব বিদ্রোহে প্রকাশ পায়। এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসন ও জায়নবাদী উপস্থিতির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের একটি বড় প্রকাশ।
![]() |
© Fox Photos/Getty Images |
- বিদ্রোহের সূচনা: ১৯৩৬ সালের এপ্রিলে ফিলিস্তিনি শ্রমিকরা সাধারণ ধর্মঘট ডাকেন, ইহুদি অভিবাসন বন্ধ এবং স্বাধীনতার দাবিতে। এটি দ্রুত সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়। ফিলিস্তিনি কৃষক ও শহরবাসী জায়নবাদী বসতি ও ব্রিটিশ স্থাপনায় হামলা চালায়।
- ব্রিটিশ প্রতিক্রিয়া: ব্রিটেন ২০,০০০ সৈন্য মোতায়েন করে। গ্রামে গ্রামে অভিযান চালানো হয়, বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়, এবং গণগ্রেপ্তার করা হয়। ব্রিটিশ বাহিনী বিমান হামলা, গণপিটুনি, এবং গণহত্যার মতো কৌশল ব্যবহার করে। প্রায় ৫,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত, ১০,০০০ আহত, এবং ৬,০০০ গ্রেপ্তার হয়।
- জায়নবাদী সহযোগিতা: হাগানার সদস্যরা ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে যৌথভাবে ফিলিস্তিনি বিদ্রোহীদের দমনে অংশ নেয়। এটি তাদের সামরিক অভিজ্ঞতা বাড়ায়।
১৯৩৯ সালে বিদ্রোহ দমিত হয়, কিন্তু ফিলিস্তিনি সমাজ ও নেতৃত্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অনেক নেতা নির্বাসিত বা নিহত হন, যা ১৯৪৮ সালে নাকবার সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। এই দমন নাকবার পূর্বে ফিলিস্তিনিদের উপর সামরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, যা জায়নবাদীদের জন্য পথ প্রশস্ত করে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটেন ম্যান্ডেট শেষ করার ঘোষণা দেয়। জাতিসংঘ রেজোলিউশন ১৮১ (২৯ নভেম্বর, ১৯৪৭) ফিলিস্তিনকে দুই রাষ্ট্রে ভাগ করে: ৫৫% ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য এবং ৪৫% আরব রাষ্ট্রের জন্য। ফিলিস্তিনিরা এটি প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু জায়নবাদীরা আক্রমণ শুরু করে।
৩. নাকবার ঘটনাপ্রবাহ
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর থেকে জায়নবাদী বাহিনী "প্ল্যান ডালেত" (Plan Dalet) বাস্তবায়ন শুরু করে, যা ফিলিস্তিনিদের নৃতাত্ত্বিক নির্মূলনের একটি সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত কৌশল ছিল। এই পরিকল্পনা ১৯৪৫ সালে হাগানা কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল এবং ১৯৪৭ সালের শেষে জাতিসংঘের ফিলিস্তিন ভাগের সিদ্ধান্ত (রেজোলিউশন ১৮১) ঘোষণার পর তা কার্যকর করা শুরু হয়। "প্ল্যান ডালেত"-এর উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড থেকে আরব জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য একটি একক জনসংখ্যাগত ভিত্তি তৈরি করা। এই পরিকল্পনায় গ্রাম ও শহর ধ্বংস করা, বোমা হামলা, গণহত্যা, এবং মানসিক যুদ্ধের মতো কৌশল ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের জুলাই পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলে, যা ফিলিস্তিনি সমাজকে বিধ্বস্ত করে এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে। এই সময়কালে জায়নবাদী বাহিনী—হাগানা, ইরগুন, এবং লেহি—একটি সমন্বিত আক্রমণ পরিচালনা করে, যার ফলে ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়িঘর, জমি, এবং জীবন হারায়। নিম্নে এই ঘটনাপ্রবাহের প্রধান দিকগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হলো।
৩.১ প্রধান ঘটনা
নাকবার সময়কালে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য নির্ধারণ করে। এই ঘটনাগুলো জায়নবাদী বাহিনীর নৃশংসতা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের উপর এর প্রভাব প্রকাশ করে।
৩.১.১ ডেইর ইয়াসিন গণহত্যা (৯ এপ্রিল, ১৯৪৮)
ডেইর ইয়াসিন ছিল জেরুজালেমের কাছে একটি ছোট ফিলিস্তিনি গ্রাম। ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল ভোরে জায়নবাদী গোষ্ঠী ইরগুন এবং লেহি এই গ্রামে আক্রমণ চালায়। এই হামলায় ১০০ জনেরও বেশি নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি—নারী, শিশু, এবং বৃদ্ধসহ—নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আক্রমণকারীরা বাড়িতে বাড়িতে প্রবেশ করে বাসিন্দাদের গুলি করে, হাতবোমা ছুড়ে, এবং কিছু ক্ষেত্রে ছুরি দিয়ে হত্যা করে। বেঁচে যাওয়া কিছু মানুষকে প্যারেডের মতো জেরুজালেমে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে হত্যা করা হয়।
এই গণহত্যার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ইতিহাসবিদ ইলান পাপ্পে এটিকে "প্ল্যান ডালেত"-এর একটি কৌশল হিসেবে বর্ণনা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল অন্যান্য গ্রামের বাসিন্দাদের ভয় দেখিয়ে পালাতে বাধ্য করা। ডেইর ইয়াসিনের পর আশপাশের অনেক গ্রামের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়, যা নাকবার উচ্ছেদ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
৩.১.২ শহর পতন
নাকবার সময় ফিলিস্তিনের প্রধান শহরগুলো জায়নবাদী বাহিনীর হাতে দ্রুত পতন হয়, যা ফিলিস্তিনি সমাজের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোকে ধ্বংস করে। উল্লেখযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- আকরে (Acre): ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শহর ১৯৪৮ সালের মে মাসে হাগানার কাছে পড়ে। মুস্তফা আব্বাসি লিখেছেন, আকরের বাসিন্দারা ছয় মাস ধরে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিলেও, জায়নবাদী বাহিনীর ভারী অস্ত্র ও সংগঠিত আক্রমণের কাছে টিকতে পারেনি।
- টাইবেরিয়াস (Tiberias): এই শহরে আরব-ইহুদি সম্পর্ক ঐতিহ্যগতভাবে ভালো থাকলেও, ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে এটি দখল হয়। আরব নেতৃত্ব সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করলেও, জায়নবাদী আক্রমণের ফলে শহরটি প্রায় সম্পূর্ণ ইহুদি হয়ে যায়।
- হাইফা: ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে হাইফা পতন হয়। ওয়ালিদ খালিদি লিখেছেন, জায়নবাদী বাহিনী বোমা হামলা ও ভয় দেখিয়ে হাজার হাজার বাসিন্দাকে পালাতে বাধ্য করে।
- লিড্ডা (Lydda): জুলাই ১৯৪৮-এ এই শহর দখল হয়। স্পিরো মুনায়্যারের বর্ণনায়, লিড্ডার বাসিন্দারা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও, জায়নবাদী বাহিনী ৮০,০০০ মানুষকে উচ্ছেদ করে, যা নাকবার সবচেয়ে বড় একক উচ্ছেদ ঘটনা।
এই শহরগুলোর পতন ফিলিস্তিনি জনজীবনের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয় এবং শরণার্থী সংকটকে বাড়িয়ে তোলে।
৩.১.৩ গ্রাম ধ্বংস
নাকবার একটি কেন্দ্রীয় উপাদান ছিল ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোর পদ্ধতিগত ধ্বংস। "প্ল্যান ডালেত"-এর নির্দেশ অনুযায়ী, ৫৩০টিরও বেশি গ্রাম ধ্বংস করা হয়। উদাহরণস্বরূপ:
- বায়ত আফফা: উম জাবর উইশাহর বর্ণনায়, এই গ্রামে জায়নবাদী আক্রমণের সময় পরিবারগুলো রাতের অন্ধকারে শিশুদের পিঠে বেঁধে পালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তারা গাজার আল-বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।
- পশ্চিম গ্যালিলি: নাফেজ নাজ্জাল ছয়টি গ্রামের বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকারে দেখান, কীভাবে এই এলাকা সম্পূর্ণ "পরিচ্ছন্ন" করা হয়। গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়, এবং বাসিন্দারা স্থানচ্যুত হয়।
এই ধ্বংস ফিলিস্তিনি কৃষি অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে বিপর্যস্ত করে, যা তাদের জন্য পুনর্বাসনকে অসম্ভব করে তোলে।
৩.২ যুদ্ধ ও ফলাফল
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ডেভিড বেন-গুরিয়ন ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির একদিন আগে। এই ঘোষণার পর জর্ডান, মিশর, সিরিয়া, এবং লেবাননের আরব সেনারা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে জায়নবাদী অগ্রগতি রোধ করতে। তবে, আরব বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং জায়নবাদীদের উন্নত সামরিক সংগঠনের কারণে তারা ব্যর্থ হয়।
৩.২.১ যুদ্ধের পরিধি
যুদ্ধটি ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের জুলাই পর্যন্ত চলে। এই সময়ে জায়নবাদী বাহিনী বোমা হামলা, গণহত্যা, এবং গ্রাম ধ্বংসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। আরব সেনারা কিছু এলাকায় প্রতিরোধ গড়লেও, তারা ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অংশ রক্ষা করতে পারেনি। ১৯৪৯ সালে ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৩.২.২ ফলাফল
যুদ্ধের শেষে নাকবার ভয়াবহ পরিণতি প্রকাশ পায়:
- মৃত্যু: প্রায় ১৩,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে অনেকে গণহত্যা ও সরাসরি সংঘর্ষে প্রাণ হারায়।
- উচ্ছেদ: ৭৫০,০০০ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়। তারা জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, এবং গাজায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। এটি আধুনিক ইতিহাসের বৃহত্তম শরণার্থী সংকটের সূচনা করে।
- ভূখণ্ড দখল: ইসরায়েল ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৭৮% (প্রায় ২০,০০০ বর্গকিলোমিটার) দখল করে। বাকি ২২%—পশ্চিম তীর জর্ডানের এবং গাজা মিশরের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
এই ফলাফল ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের জন্য একটি বিপর্যয় ছিল। যুদ্ধের পর ইসরায়েল উচ্ছেদিতদের সম্পত্তি দখল করে এবং তাদের ফেরার অধিকার অস্বীকার করে, যা নাকবার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবকে আরও গভীর করে।
নাকবার ঘটনাপ্রবাহ ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একটি ট্র্যাজেডি এবং জায়নবাদীদের জন্য ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সাফল্য। ডেইর ইয়াসিনের মতো গণহত্যা এবং শহর-গ্রামের ধ্বংস ফিলিস্তিনিদের শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে। যুদ্ধের ফলাফল ফিলিস্তিনি ভূমি ও পরিচয়ের অপূরণীয় ক্ষতি করে, যা ২০২৫ সাল পর্যন্ত তাদের জীবনে প্রভাব ফেলছে।
৪. ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
নাকবা শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটি ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনে একটি গভীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি। যারা এই বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তাদের বর্ণনা নাকবার ভয়াবহতা, অনিশ্চয়তা, এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবকে তুলে ধরে। এই অভিজ্ঞতাগুলো ফিলিস্তিনি পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়েছে। নিম্নে চারজন ব্যক্তির বিস্তারিত অভিজ্ঞতা বর্ণিত হলো, যারা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নাকবার প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছেন।
৪.১ মুহাম্মদ হাল্লাজ: জাফার এক কিশোরের চোখে নাকবা
মুহাম্মদ হাল্লাজ ১৯৪৭ সালে জাফায় একজন কিশোর ছিলেন। তিনি Journal of Palestine Studies-এ তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, যা নাকবার সূচনার একটি জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে। ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি স্কুলে পৌঁছে চকবোর্ডে লেখা দেখেন: “গতকাল, ২৯ নভেম্বর ১৯৪৭, জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ভাগ করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” এই সংবাদ তাকে "অযৌক্তিক ও অবিশ্বাস্য" মনে হয়। তিনি ভেবেছিলেন, ফিলিস্তিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব জনগোষ্ঠীর জমি কীভাবে ইহুদিদের দেওয়া যায়, যারা তখন জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ ছিল।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পর জাফায় জীবন দ্রুত বদলে যায়। জায়নবাদী মিলিশিয়ার আক্রমণ শুরু হলে, হাল্লাজের পরিবার ও প্রতিবেশীরা আতঙ্কে পড়ে। বোমা হামলা, গুলির শব্দ, এবং পালিয়ে যাওয়া মানুষের ভিড় তার কিশোর মনে গভীর ছাপ ফেলে। তিনি লিখেছেন, “এটি ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, যতক্ষণ না এর সম্মিলিত প্রভাব ফিলিস্তিন এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অবিচার ও অশান্তির এক নতুন যুগে নিয়ে যায়।” তার জীবন চিরতরে বদলে যায়—স্কুল, বন্ধু, এবং শৈশবের স্মৃতি সব হারিয়ে যায়। হাল্লাজের বর্ণনা নাকবাকে একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি এবং সমষ্টিগত বিপর্যয় হিসেবে প্রতিফলিত করে।
৪.২ ঘাদা কারমি: একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের নির্বাসন
ঘাদা কারমি একটি সম্ভ্রান্ত ফিলিস্তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য ছিলেন। তার পরিবার জেরুজালেমে বাস করত, যেখানে তারা একটি আরামদায়ক জীবনযাপন করত। Journal of Palestine Studies-এ "The 1948 Exodus: A Family Story" প্রবন্ধে তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে নাকবা তার পরিবারের জীবনকে চিরতরে পরিবর্তন করে দেয়। ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী আক্রমণ তীব্র হলে, তার পরিবার প্রাণ বাঁচাতে পালাতে বাধ্য হয়।
কারমির বর্ণনায়, তারা প্রথমে ভেবেছিল এটি সাময়িক হবে, কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারেন যে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তার বাবা, একজন শিক্ষিত ও সম্মানিত ব্যক্তি, তাদের সম্পত্তি এবং সামাজিক মর্যাদা হারান। পরিবারটি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে চলে যায়, যেখানে তারা একটি নতুন জীবন শুরু করে। কিন্তু এই নির্বাসন তার মধ্যে একটি "স্থায়ী হৃদয়বিদারক" অনুভূতি রেখে যায়। তিনি লিখেছেন, “ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা রাজনৈতিক আদর্শের ফল হলেও, এটি প্রতিটি ফিলিস্তিনির জীবনকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বদলে দিয়েছে।”
কারমির গল্প দেখায় যে নাকবা শুধু দরিদ্র বা গ্রামীণ ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের জন্যও সমানভাবে বিধ্বংসী ছিল। তার অভিজ্ঞতা নাকবার ব্যাপকতা এবং এর সামাজিক স্তর জুড়ে প্রভাবকে তুলে ধরে।
৪.৩ ইলিয়াস স্রুজি: গ্যালিলির একটি গ্রাম থেকে বারবার স্থানচ্যুতি
ইলিয়াস স্রুজি গ্যালিলি অঞ্চলের একটি ফিলিস্তিনি গ্রামে বাস করতেন। তিনি Journal of Palestine Studies-এ "The Fall of a Galilean Village during the 1948 Palestine War" এবং "The Last Days of 'Free Galilee'" প্রবন্ধে তার পরিবারের স্থানচ্যুতির বর্ণনা দিয়েছেন। ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী বাহিনী গ্যালিলিতে আক্রমণ শুরু করলে, তার পরিবার পালানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু পরিকল্পনাগুলো বারবার ব্যর্থ হয়, এবং তারা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পালাতে থাকে।
স্রুজি বর্ণনা করেছেন কীভাবে তারা রাতের অন্ধকারে পায়ে হেঁটে পালিয়েছে, সঙ্গে শুধু অল্প কিছু জিনিসপত্র। গুলির শব্দ, গ্রামে আগুন লাগানোর দৃশ্য, এবং পরিবারের সদস্যদের ভয় ও অনিশ্চয়তা তার মনে গভীরভাবে অঙ্কিত হয়ে যায়। তিনি লিখেছেন, “প্রতিটি পালানোর পরিকল্পনা ভেস্তে যেত, আর আমাদের বেঁচে থাকার জন্য নতুন করে লড়তে হতো।” শেষ পর্যন্ত তার পরিবার স্থানচ্যুত হয়ে একটি শরণার্থী জীবনের মুখোমুখি হয়।
স্রুজির অভিজ্ঞতা ফিলিস্তিনি গ্রামবাসীদের দুর্দশার প্রতিনিধিত্ব করে, যারা নাকবার সময় বারবার স্থানচ্যুতি ও অস্থিরতার শিকার হয়েছিল। তার গল্প বড় ইতিহাসের পেছনে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিগত সংগ্রামগুলোকে আলোকিত করে।
৪.৪ উম জাবর উইশাহ: বায়ত আফফা থেকে গাজার আল-বুরেইজ শিবিরে
উম জাবর উইশাহ বায়ত আফফা গ্রামের একজন বাসিন্দা ছিলেন। তিনি Journal of Palestine Studies-এ "Palestinian Voices: The 1948 War and Its Aftermath" প্রবন্ধে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী বাহিনী তার গ্রামে আক্রমণ চালালে, তার পরিবার তাদের সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে পালাতে বাধ্য হয়। তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে তারা শিশুদের পিঠে বেঁধে রাতের অন্ধকারে পালিয়েছিলেন, গ্রামে আগুনের শিখা এবং গুলির শব্দ পেছনে রেখে।
তার পরিবার প্রথমে আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়, কিন্তু জায়নবাদী আক্রমণের বিস্তারের সাথে তাদের বারবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়। শেষ পর্যন্ত তারা গাজা উপত্যকার আল-বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে স্থায়ীভাবে আশ্রয় নেয়। উম জাবর লিখেছেন, “আমরা শুধু আমাদের জীবন নিয়ে পালাতে পেরেছি; বাড়ি, জমি, সবকিছু পড়ে রইল।” তার বর্ণনায় ভয়, বিভ্রান্তি, এবং অনিশ্চয়তার একটি স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে।
এই অভিজ্ঞতা গ্রামীণ ফিলিস্তিনিদের জন্য নাকবার প্রভাবকে প্রতিফলিত করে, যারা তাদের কৃষিজীবী জীবন থেকে সম্পূর্ণ উৎখাত হয়ে শরণার্থী শিবিরে সীমাবদ্ধ হয়েছিল।
এই চারটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নাকবার বহুমুখী প্রভাবকে তুলে ধরে। মুহাম্মদ হাল্লাজের গল্প শহুরে কিশোরদের জীবনের ধ্বংস দেখায়, ঘাদা কারমি মধ্যবিত্তের নির্বাসনের কথা বলে, ইলিয়াস স্রুজি গ্রামীণ স্থানচ্যুতির চিত্র দেয়, এবং উম জাবর উইশাহ শরণার্থী জীবনের শুরু বর্ণনা করে। এই বর্ণনাগুলো প্রমাণ করে যে নাকবা শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং প্রতিটি ফিলিস্তিনির জীবনে একটি গভীর ব্যক্তিগত ক্ষত।
৫. পরিণতি
নাকবা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একটি বিপর্যয়কর ঘটনা ছিল, যার পরিণতি শুধু ১৯৪৮ সালে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং আজও (২০২৫ সাল পর্যন্ত) তাদের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। যুদ্ধের শেষে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি জমি, সম্পত্তি, এবং জাতীয় পরিচয় হারানোর সূচনা করে। ইসরায়েলি আইনের মাধ্যমে উচ্ছেদিতদের সম্পত্তি দখল, তাদের ফেরার অধিকার অস্বীকার, এবং শরণার্থী সংকটের সৃষ্টি নাকবার প্রধান পরিণতি। এই অংশে এই ফলাফলগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
৫.১ ইসরায়েলি আইন ও সম্পত্তি দখল
১৯৪৮-৪৯ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েল নতুন রাষ্ট্র হিসেবে তার ভূমি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক আইন প্রণয়ন করে। এর মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইন ছিল:
- "অ্যাবসেন্টি প্রপার্টি ল" (Absentee Property Law, ১৯৫০): এই আইনের মাধ্যমে ইসরায়েল সরকার উচ্ছেদিত ফিলিস্তিনিদের সম্পত্তি—জমি, বাড়ি, ব্যবসা, এমনকি ব্যক্তিগত জিনিসপত্র—দখল করে নেয়। আইনটি "অনুপস্থিত" (absentee) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে যে কোনো ফিলিস্তিনিকে, যিনি ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বরের পর থেকে তাদের সম্পত্তি ছেড়ে গেছেন, এমনকি যদি তারা জোরপূর্বক উচ্ছেদিত হয়ে থাকেন বা ইসরায়েলের অন্য এলাকায় থাকেন। এই আইনের ফলে প্রায় ৭০% ফিলিস্তিনি জমি ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। উদাহরণস্বরূপ, জাফা, হাইফা, এবং লিড্ডার মতো শহরে ফিলিস্তিনিদের পরিত্যক্ত বাড়িগুলো ইহুদি অভিবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়া ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে এবং তাদের জন্য পুনর্বাসনকে অসম্ভব করে তোলে।
- "ল অফ রিটার্ন" (Law of Return, ১৯৫০): এই আইন বিশ্বের যে কোনো ইহুদিকে ইসরায়েলে ফিরে নাগরিকত্ব গ্রহণের অধিকার দেয়। এটি জায়নবাদী আদর্শের প্রতিফলন, যা ইসরায়েলকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু একই সময়ে, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের তাদের জন্মভূমিতে ফেরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। জাতিসংঘের রেজোলিউশন ১৯৪ (১৯৪৮) শরণার্থীদের ফেরার অধিকারের কথা বললেও, ইসরায়েল এটি বাস্তবায়ন করেনি। এই দ্বৈত নীতি ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি গভীর অবিচার সৃষ্টি করে, যারা তাদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্য দেশে শরণার্থী জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।
এই আইনগুলো নাকবার পরিণতিকে স্থায়ী করে এবং ইসরায়েলের ইহুদি জনসংখ্যার প্রাধান্য নিশ্চিত করে। ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি তাদের সম্পত্তি ও পরিচয় হারানোর একটি আইনি স্বীকৃতি ছিল।
৫.২ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি
যুদ্ধের পর প্রায় ১৫০,০০০ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের নতুন সীমানার মধ্যে থেকে যায়। এরা সরাসরি শরণার্থী হিসেবে দেশের বাইরে যেতে পারেনি, কিন্তু তাদের গ্রাম ও শহর থেকে বিতাড়িত হয়ে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্যালিলি এবং নেগেভ অঞ্চলের অনেক ফিলিস্তিনি তাদের বাড়ি হারিয়ে অন্য শহরে বা গ্রামে আশ্রয় নেয়।
এই ফিলিস্তিনিদের "প্রেজেন্ট অ্যাবসেন্টি" (present absentees) বলা হয়, কারণ তারা ইসরায়েলে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকলেও, "অ্যাবসেন্টি প্রপার্টি ল" এর আওতায় তাদের সম্পত্তি দখল করা হয়। তাদের অনেককে আরব গ্রামে বা শহরের প্রান্তে সীমাবদ্ধ করা হয়, যেখানে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের চলাচল সীমিত করা হয়, এবং সামরিক শাসনের অধীনে (১৯৪৮-১৯৬৬) তাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। এই অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি অদৃশ্য কিন্তু গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, যা তাদের নিজ ভূমিতে অপরিচিত করে তোলে।
৫.৩ শরণার্থী সংকট এবং ২০২৫ সালের পরিস্থিতি
নাকবার সবচেয়ে স্পষ্ট পরিণতি ছিল শরণার্থী সংকট। ১৯৪৮-৪৯ সালে ৭৫০,০০০ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদিত হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। তারা জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, এবং মিশর-নিয়ন্ত্রিত গাজায় শরণার্থী শিবিরে বসতি স্থাপন করে। জাতিসংঘ ১৯৪৯ সালে UNRWA (United Nations Relief and Works Agency) প্রতিষ্ঠা করে তাদের সহায়তার জন্য, যা আজও তাদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং খাদ্য সরবরাহ করে।
২০২৫ সালে এই শরণার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫.৮ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে (UNRWA তথ্য, ২০২৫)। এই জনসংখ্যা নিম্নলিখিত এলাকায় বাস করে:
- পশ্চিম তীর: প্রায় ১ মিলিয়ন শরণার্থী ১৯টি শিবিরে বাস করে।
- গাজা: ১.৫ মিলিয়ন শরণার্থী ৮টি শিবিরে, যেখানে ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েলি অবরোধ চলছে।
- জর্ডান: ২.২ মিলিয়ন শরণার্থী, যাদের অনেকে নাগরিকত্ব পেলেও তাদের ফিলিস্তিনি পরিচয় অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
- লেবানন: ৪৫০,০০০ শরণার্থী ১২টি শিবিরে, যেখানে তারা চাকরি ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
- সিরিয়া: ৫৫০,০০০ শরণার্থী, যদিও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ (২০১১ থেকে) তাদের জীবনকে আরও জটিল করেছে।
২০২৫ সালে এই শরণার্থীদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন। গাজায় অবরোধের কারণে খাদ্য ও ওষুধের ঘাটতি তীব্র হয়েছে। UNRWA-এর ১৯ মার্চ, ২০২৫-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, গাজার ৭০% শরণার্থী পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ এবং সামরিক অভিযান শরণার্থীদের জন্য জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। লেবানন ও সিরিয়ায় শরণার্থীরা দারিদ্র্য, বৈষম্য, এবং অস্থিতিশীলতার মধ্যে বাস করে। এই সংকট নাকবার একটি চলমান পরিণতি, যা সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখায় না।
৫.৪ তাৎপর্য ও প্রভাব
নাকবার পরিণতি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একটি ত্রিমাত্রিক ক্ষতি সৃষ্টি করে:
- ভৌগোলিক: তাদের ভূমির ৭৮% হারানো।
- অর্থনৈতিক: সম্পত্তি ও জীবিকা হারিয়ে দারিদ্র্য ও নির্ভরতা।
- সামাজিক-সাংস্কৃতিক: পরিবার বিচ্ছিন্নতা, গ্রামীণ জীবনের ধ্বংস, এবং পরিচয়ের সংকট।
ইসরায়েলের জন্য এটি একটি জয় ছিল, যা তাদের জনসংখ্যাগত ও ভৌগোলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি একটি অমীমাংসিত ট্র্যাজেডি, যা ২০২৫ সালে ৫.৮ মিলিয়ন শরণার্থীর জীবনে প্রতিফলিত হয়। এই পরিণতি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরও জটিল করে তুলেছে, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা এই সংকটকে দীর্ঘায়িত করেছে।
৬. ঐতিহাসিক বিতর্ক
নাকবার ঘটনাপ্রবাহ ও কারণ নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি বর্ণনার মধ্যে গভীর বৈপরীত্য রয়েছে, যা নাকবার প্রকৃতি ও দায়িত্ব নির্ধারণে মূল প্রশ্ন তুলে ধরে। ইসরায়েলের প্রচলিত দাবি এবং এর বিরুদ্ধে পণ্ডিতদের গবেষণা এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে। ফিলিস্তিনি পণ্ডিতরা দীর্ঘদিন ধরে নাকবাকে একটি পরিকল্পিত উচ্ছেদ হিসেবে চিহ্নিত করলেও, ১৯৮০-এর দশকে ইসরায়েলি "নিউ হিস্টোরিয়ান্স" এর সমর্থনে নতুন প্রমাণ উপস্থাপন করে। এই অংশে এই বিতর্কের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
৬.১ ইসরায়েলি বর্ণনা: "নেতাদের নির্দেশে" পালানো
ইসরায়েলের প্রচলিত বা আনুষ্ঠানিক বর্ণনা দাবি করে যে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা স্বেচ্ছায় তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এই দাবির মূল ভিত্তি হলো, আরব নেতারা রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধের সময় অস্থায়ীভাবে চলে যেতে বলেছিলেন, প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে আরব সেনারা জয়ী হলে তারা ফিরে আসতে পারবে। এই বর্ণনা অনুসারে, ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদে জায়নবাদী বাহিনীর কোনো দায় নেই; বরং এটি ফিলিস্তিনিদের নিজেদের সিদ্ধান্ত এবং আরব নেতৃত্বের ভুল নির্দেশের ফল।
এই দাবি ১৯৪৮ সালের পর থেকে ইসরায়েলি প্রচারণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রায়ই বলেছেন যে ফিলিস্তিনিরা "অযৌক্তিকভাবে" জায়নবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেছে, যা তাদের পালাতে বাধ্য করেছে। এই বর্ণনা পশ্চিমা মিডিয়া ও ইতিহাসে দীর্ঘদিন প্রভাবশালী ছিল, যা ফিলিস্তিনি অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করে এবং জায়নবাদী সহিংসতার দায় অস্বীকার করে। তবে, এই দাবির কোনো প্রামাণিক রেডিও সম্প্রচার বা নথি পাওয়া যায়নি, যা পরবর্তী গবেষণায় ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে।
৬.২ ওয়ালিদ খালিদি: "প্ল্যান ডালেত" এবং পরিকল্পিত উচ্ছেদ
ফিলিস্তিনি পণ্ডিত ওয়ালিদ খালিদি ইসরায়েলি বর্ণনার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তার প্রবন্ধ "Plan Dalet: Master Plan for the Conquest of Palestine" (১৯৫৯) এবং অন্যান্য লেখায় তিনি দেখান যে নাকবা কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা নয়, বরং একটি পরিকল্পিত নৃতাত্ত্বিক নির্মূলন প্রক্রিয়া। খালিদি "প্ল্যান ডালেত"-এর বিশদ বিশ্লেষণ করেন, যা ১৯৪৫ সালে হাগানা কর্তৃক প্রণীত হয় এবং ১৯৪৮ সালে বাস্তবায়িত হয়।
"প্ল্যান ডালেত" ছিল জায়নবাদী নেতৃত্বের একটি নীলনকশা, যার লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনের আরব জনসংখ্যাকে হ্রাস করে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য ভূমি নিশ্চিত করা। এই পরিকল্পনায় গ্রাম ধ্বংস, গণহত্যা (যেমন ডেইর ইয়াসিন), এবং বাসিন্দাদের ভয় দেখিয়ে পালাতে বাধ্য করার নির্দেশ ছিল। খালিদি প্রমাণ করেন যে জায়নবাদী বাহিনী এই পরিকল্পনা অনুসরণ করে ৭৫০,০০০ ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে। তিনি "Why Did the Palestinians Leave, Revisited" প্রবন্ধে ইসরায়েলি দাবি খণ্ডন করে দেখান যে কোনো আরব নেতা পালানোর নির্দেশ দেয়নি; বরং, ফিলিস্তিনিরা জায়নবাদী সহিংসতার কারণে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়েছিল।
খালিদির কাজ ফিলিস্তিনি দৃষ্টিভঙ্গির জন্য "ন্যারেটিভের অনুমতি" (permission to narrate) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ। তিনি Journal of Palestine Studies-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এই বিতর্কে একটি প্রামাণিক কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন।
৬.৩ ইলান পাপ্পে: নৃতাত্ত্বিক নির্মূলনের বিশদ বিবরণ
ইসরায়েলি ঐতিহাসিক ইলান পাপ্পে তার গ্রন্থ "The 1948 Ethnic Cleansing of Palestine" (২০০৬)-এ নাকবার একটি বিশদ ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন। তিনি ইসরায়েলি আর্কাইভ থেকে নতুন প্রকাশিত নথি ব্যবহার করে প্রমাণ করেন যে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ একটি পূর্বপরিকল্পিত জায়নবাদী প্রকল্প ছিল। পাপ্পে "প্ল্যান ডালেত"-কে "জায়নবাদের একচেটিয়া ইহুদি উপস্থিতির আদর্শিক প্রচেষ্টা" হিসেবে বর্ণনা করেন।
তার গবেষণায় দেখা যায় যে জায়নবাদী নেতারা—যেমন ডেভিড বেন-গুরিয়ন—ফিলিস্তিনি জনসংখ্যাকে "সমস্যা" হিসেবে দেখতেন এবং তাদের অপসারণকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য মনে করতেন। পাপ্পে ডেইর ইয়াসিন গণহত্যা, লিড্ডার উচ্ছেদ, এবং গ্রাম ধ্বংসের মতো ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, “এটি কোনো যুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল না; এটি একটি সুসংগঠিত নৃতাত্ত্বিক নির্মূলন।” পাপ্পের কাজ ইসরায়েলি সমাজে বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং তাকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে, কিন্তু এটি নাকবার সত্যতাকে বিশ্বব্যাপী প্রকাশ করে।
৬.৪ আভি শ্লাইম: ব্রিটেনের "দায়িত্বজ্ঞানহীন" প্রস্থান
ইসরায়েলি-ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আভি শ্লাইম তার প্রবন্ধ "Britain and the Arab-Israeli War of 1948"-এ নাকবার জন্য ব্রিটিশ ভূমিকার সমালোচনা করেন। তিনি দেখান যে ব্রিটেন ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ম্যান্ডেট থেকে "অত্যন্ত দ্রুত ও দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে" প্রস্থান করে, যা ফিলিস্তিনিদের দুর্বল করে দেয়। শ্লাইম ব্রিটিশ আর্কাইভের নথি বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন যে ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ্য জায়নবাদী বা ফিলিস্তিনি বিরোধী ছিল না, বরং তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় মনোযোগী ছিল।
১৯৪৭ সালে ব্রিটেন জাতিসংঘের কাছে ম্যান্ডেট হস্তান্তর করে এবং ১৯৪৮ সালের ১৪ মে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে। এই দ্রুত প্রস্থানের ফলে ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব ও সমাজ প্রস্তুতির সুযোগ পায়নি, যেখানে জায়নবাদীরা ইতিমধ্যে সশস্ত্র ও সংগঠিত ছিল। শ্লাইম লিখেছেন, “ব্রিটেনের প্রস্থান ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি শূন্যতা সৃষ্টি করে, যা জায়নবাদী বিজয়কে সহজ করে।” তিনি ব্রিটেনের নিরপেক্ষতার ভানকেও সমালোচনা করেন, যা আসলে শক্তির ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে।
৬.৫ "নিউ হিস্টোরিয়ান্স" এবং ফিলিস্তিনি পণ্ডিতদের ভূমিকা
১৯৮০-এর দশকে ইসরায়েলি "নিউ হিস্টোরিয়ান্স"—ইলান পাপ্পে, বেনি মরিস, আভি শ্লাইম প্রমুখ—নতুন প্রকাশিত ইসরায়েলি আর্কাইভ ব্যবহার করে নাকবার প্রচলিত বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তারা প্রমাণ করেন যে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ স্বেচ্ছায় নয়, বরং জায়নবাদী পরিকল্পনার ফল। এই গবেষণা পশ্চিমে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়, কারণ এটি ইসরায়েলি পণ্ডিতদের কাছ থেকে এসেছিল।
তবে, ফিলিস্তিনি পণ্ডিতরা—যেমন ওয়ালিদ খালিদি—এই সত্যটি ১৯৫০-এর দশক থেকেই বলে আসছিলেন। তাদের কাজ প্রাথমিকভাবে পশ্চিমে উপেক্ষিত হয়েছিল, কারণ এটি "পক্ষপাতদুষ্ট" হিসেবে বিবেচিত হতো। "নিউ হিস্টোরিয়ান্স" আসলে ফিলিস্তিনি বর্ণনার সত্যতা নিশ্চিত করে, যা ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই বিতর্ক নাকবার ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলি দাবি ফিলিস্তিনিদের দায়ী করে, যেখানে পণ্ডিতরা জায়নবাদী পরিকল্পনা ও ব্রিটিশ নীতির ভূমিকা তুলে ধরেন। খালিদি ও পাপ্পে সরাসরি জায়নবাদী দায় প্রতিষ্ঠা করেন, আর শ্লাইম ব্রিটিশ প্রেক্ষাপট যোগ করেন। "নিউ হিস্টোরিয়ান্স" এই বিতর্ককে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য করে, যদিও ফিলিস্তিনি কণ্ঠস্বর এর মূলে থাকে। এই বিতর্ক ন্যায়বিচার ও সত্যের জন্য ফিলিস্তিনি সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
৭. চলমান নাকবা (২০২৫ পর্যন্ত)
নাকবা শুধু ১৯৪৮ সালের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়; এটি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা সময়ের সাথে নতুন রূপে প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল কর্তৃক পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, এবং পূর্ব জেরুজালেম দখলের পর থেকে এই নাকবা আরও তীব্র ও বৈচিত্র্যময় আকারে অব্যাহত রয়েছে। ইসরায়েলি নীতি—যেমন অবরোধ, বাড়ি ভাঙা, জমি বাজেয়াপ্তকরণ, এবং সামরিক অভিযান—ফিলিস্তিনিদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই চলমান নাকবার প্রভাব গাজা, পশ্চিম তীর, এবং জেরুজালেমে স্পষ্ট। নিম্নে এই তিনটি অঞ্চলের পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো।
৭.১ গাজা: অবরোধ, উচ্ছেদ, এবং খাদ্য সংকট
গাজা উপত্যকায় নাকবা ২০০৭ সাল থেকে একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে, যখন ইসরায়েল এই অঞ্চলের ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে। প্রায় ২০ লাখ মানুষ এই অবরোধের কারণে সীমিত জীবনযাপন করছে, যেখানে খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ, এবং জ্বালানির অভাব তাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে গাজার প্রবেশ ও প্রস্থানের পথগুলো বন্ধ, এবং এটি জনসংখ্যার ওপর একটি "সামূহিক শাস্তি" হিসেবে কাজ করেছে।
২০২৫ সালের মার্চে UNRWA-এর একটি রিপোর্ট (X পোস্ট, ১৯ মার্চ, ২০২৫) প্রকাশ করে যে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের নতুন উচ্ছেদ আদেশের কারণে গাজায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। এই আদেশের ফলে প্রায় ১০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যারা আবারও তাদের জীবন বাঁচাতে পালাতে বাধ্য হয়েছে। UNRWA জানিয়েছে, "বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো ক্রমশ নিদারুণ অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া হয়েছে, এবং তীব্র খাদ্য সংকটের কারণে অনেক দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।" এই রিপোর্ট আরও উল্লেখ করে যে, যুদ্ধবিরতির পরেও মানবিক সাহায্য প্রবেশে বাধা অব্যাহত রয়েছে, যা গাজার ২০ লাখ বাসিন্দার জন্য জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ১১ মার্চ পর্যন্ত, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী (OCHA উদ্ধৃত), কমপক্ষে ৪৮,৫০৩ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১১১,৯২৭ জন আহত হয়েছে। এই অবরোধ ও সামরিক হামলার ফলে গাজার অবকাঠামো—বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল—প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ২০২৫ সালে UNRWA-এর প্রতিবেদন অনুসারে, গাজার ৯০% জনসংখ্যা (প্রায় ১৯ লাখ মানুষ) বাস্তুচ্যুত, এবং অনেকে ১০ বারেরও বেশি স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। এটি নাকবার একটি চলমান রূপ, যা ফিলিস্তিনিদের জীবন থেকে স্থিতিশীলতা মুছে দিয়েছে।
৭.২ পশ্চিম তীর: সামরিক অভিযান ও ব্যাপক স্থানচ্যুতি
পশ্চিম তীরে ১৯৬৭ সালের দখলের পর থেকে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ, সামরিক নিয়ন্ত্রণ, এবং ফিলিস্তিনি গ্রাম ধ্বংসের মাধ্যমে নাকবা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫ সালে এই পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে। Al Jazeera-এর একটি প্রতিবেদন (১৫ মার্চ, ২০২৫) জানায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে পশ্চিম তীরে ৩৫,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এটি ১৯৬৭ সালের পর থেকে পশ্চিম তীরে সবচেয়ে বড় স্থানচ্যুতির ঘটনা।
জেনিন শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বাহিনী ২১ জানুয়ারি, ২০২৫ থেকে একটি বৃহৎ অভিযান শুরু করে, যা দ্বিতীয় ইন্তিফাদার (২০০০-২০০৫) পর থেকে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী অভিযান হিসেবে বিবেচিত। UNRWA-এর রিপোর্ট (১৫ মার্চ, ২০২৫) অনুসারে, জেনিন, নুর শামস, এবং তুলকারেম শিবিরে এই অভিযানে ৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৮ জন শিশু। এছাড়া, ৬ মার্চ নুর শামস শিবিরে ১৬টি বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে, যা শিবিরটিকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে।
OCHA-এর তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর, ২০২৩ থেকে ৪ মার্চ, ২০২৫ পর্যন্ত পশ্চিম তীরে (পূর্ব জেরুজালেমসহ) ৮৯৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৭ জন শিশু ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে নিহত হয়। এই অভিযানগুলো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে তাদের জমি থেকে উৎখাত করার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করছে, যা ১৯৪৮ সালের নাকবার প্রতিধ্বনি। বসতি স্থাপনকারীদের হামলা এবং সামরিক চেকপয়েন্টের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের চলাচল সীমিত করা হয়েছে, যা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
৭.৩ জেরুজালেম: বাড়ি ভাঙা এবং উচ্ছেদ
পূর্ব জেরুজালেমে, যা ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল দখল করে এবং ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করে সংযুক্ত করে, নাকবা বাড়ি ভাঙা এবং ফিলিস্তিনি পরিবার উচ্ছেদের মাধ্যমে চলছে। Middle East Eye-এর একটি প্রতিবেদন (১০ মার্চ, ২০২৫) জানায়, ২০২৫ সালে জেরুজালেমে ৫০০ ফিলিস্তিনি পরিবার তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদিত হয়েছে। এই উচ্ছেদগুলো ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের "অবৈধ নির্মাণ" বা "নিরাপত্তা" অজুহাতে পরিচালিত হয়, যদিও ফিলিস্তিনিরা দাবি করে যে এটি তাদের জমি থেকে বিতাড়নের একটি কৌশল।
শেখ জাররাহ এবং সিলওয়ানের মতো এলাকায় বাড়ি ভাঙা এবং ইহুদি বসতি স্থাপন তীব্রতর হয়েছে। UNRWA-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালে পূর্ব জেরুজালেমে কমপক্ষে ৩৫৪টি কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি ধারাবাহিক স্থানচ্যুতি সৃষ্টি করছে, যা ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া নাকবার একটি আধুনিক সংস্করণ। এছাড়া, আল-আকসা মসজিদের আশপাশে উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং ফিলিস্তিনিদের গ্রেপ্তার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি হ্রাস করার প্রচেষ্টাকে নির্দেশ করে।
৭.৪ তাৎপর্য ও চলমান প্রভাব
২০২৫ সাল পর্যন্ত চলমান নাকবা ফিলিস্তিনিদের জন্য তিনটি মূল ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে:
- ভৌগোলিক: গাজায় অবরোধ, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ, এবং জেরুজালেমে জমি বাজেয়াপ্তকরণ তাদের ভূমির পরিমাণ ক্রমশ সংকুচিত করছে।
- জনসংখ্যাগত: বাস্তুচ্যুতি এবং উচ্ছেদ ফিলিস্তিনি জনসংখ্যাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা তাদের সমষ্টিগত পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলেছে।
- মানবিক: খাদ্য সংকট, স্বাস্থ্যসেবার অভাব, এবং শিক্ষার সুযোগ হ্রাস ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রার মানকে ধ্বংস করছে।
গাজায় ১০,০০০ নতুন বাস্তুচ্যুতি (UNRWA, ১৯ মার্চ, ২০২৫), পশ্চিম তীরে ৩৫,০০০ স্থানচ্যুতি (Al Jazeera, ১৫ মার্চ, ২০২৫), এবং জেরুজালেমে ৫০০ পরিবারের উচ্ছেদ (Middle East Eye, ১০ মার্চ, ২০২৫) প্রমাণ করে যে নাকবা একটি সমাপ্ত ঘটনা নয়, বরং একটি জীবন্ত বাস্তবতা। এই চলমান প্রক্রিয়া ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের দাবিকে আরও জরুরি করে তুলেছে, যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা এই সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে।
৮. বিশ্লেষণ
নাকবা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং তাদের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সংগ্রামের একটি জীবন্ত প্রতীক। ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া এই বিপর্যয় ফিলিস্তিনিদের জীবনে একটি একক ঘটনা হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি; এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে, যা তাদের ভূমি, পরিচয়, এবং ভবিষ্যৎকে ক্রমাগত হুমকির মুখে ফেলেছে। এই বিশ্লেষণে নাকবার প্রতীকী তাৎপর্য, এর ধারাবাহিকতা, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তার ভূমিকা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
৮.১ নাকবা: ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতীক
নাকবা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, এবং মানসিক প্রতীক হিসেবে কাজ করে, যা তাদের অস্তিত্বের সংগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৪৮ সালে ৭৫০,০০০ ফিলিস্তিনির উচ্ছেদ এবং ৫৩০টিরও বেশি গ্রাম ধ্বংস শুধু একটি শারীরিক ক্ষতি ছিল না; এটি তাদের জাতীয় পরিচয় ও স্বাধীনতার স্বপ্নের ওপর আঘাত হানে। ফিলিস্তিনি সাহিত্যে, শিল্পে, এবং মৌখিক ইতিহাসে নাকবা একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, কবি মাহমুদ দারউইশের কবিতায় নাকবা ফিলিস্তিনি জীবনের "চিরন্তন ক্ষত" হিসেবে প্রকাশ পায়।
এই প্রতীক ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের শক্তি জোগায়। প্রতি বছর ১৫ মে "নাকবা দিবস" পালনের মাধ্যমে তারা তাদের অধিকার ও ফেরার দাবি (Right of Return) পুনর্ব্যক্ত করে। নাকবা তাদের সংগ্রামকে একটি বৈশ্বিক মানবাধিকার আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছে, যা জাতিসংঘের রেজোলিউশন ১৯৪ (১৯৪৮)-এর শরণার্থীদের ফেরার অধিকারের দাবির সাথে সংযুক্ত। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি সমষ্টিগত স্মৃতি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়ে তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত রাখে।
৮.২ একটি চলমান প্রক্রিয়া
নাকবা কোনো সমাপ্ত ঘটনা নয়; এটি সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়ে একটি চলমান প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। ১৯৬৭ সালে পশ্চিম তীর, গাজা, এবং পূর্ব জেরুজালেম দখলের পর থেকে ইসরায়েলি নীতি—যেমন বসতি সম্প্রসারণ, অবরোধ, এবং বাড়ি ভাঙা—নাকবার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। ২০২৫ সালে এই প্রক্রিয়া আরও স্পষ্ট হয়েছে। গাজায় ১০,০০০ নতুন বাস্তুচ্যুতি (UNRWA, ১৯ মার্চ, ২০২৫), পশ্চিম তীরে ৩৫,০০০ মানুষের স্থানচ্যুতি (Al Jazeera, ১৫ মার্চ, ২০২৫), এবং জেরুজালেমে ৫০০ পরিবারের উচ্ছেদ (Middle East Eye, ১০ মার্চ, ২০২৫) প্রমাণ করে যে নাকবা একটি জীবন্ত বাস্তবতা।
এই চলমান নাকবা ফিলিস্তিনিদের জীবনে তিনটি মাত্রায় প্রভাব ফেলছে:
- ভৌগোলিক: ইসরায়েলি বসতি এবং সামরিক দখলদারিত্ব ফিলিস্তিনি ভূমির পরিমাণ ক্রমশ সংকুচিত করছে। ১৯৪৮ সালে ৭৮% ভূমি হারানোর পর, বাকি ২২% (পশ্চিম তীর ও গাজা)ও এখন হুমকির মুখে।
- জনসংখ্যাগত: বারবার স্থানচ্যুতি এবং উচ্ছেদ ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়কে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ২০২৫ সালে ৫.৮ মিলিয়ন শরণার্থী বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্ত, যা তাদের সমষ্টিগত শক্তি ক্ষুণ্ণ করছে।
- মানবিক: গাজায় অবরোধ, পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযান, এবং জেরুজালেমে সম্পত্তি হারানো ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। খাদ্য সংকট, শিক্ষার অভাব, এবং স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা তাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করেছে।
ইতিহাসবিদ ইলান পাপ্পে "চলমান নাকবা" (Ongoing Nakba) শব্দটি ব্যবহার করে বলেন, “ইসরায়েলি নীতি ১৯৪৮ সালের উচ্ছেদকে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করেছে।” এই ধারাবাহিকতা ফিলিস্তিনিদের জন্য শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, বর্তমানের একটি দৈনন্দিন সংগ্রাম।
৮.৩ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা
নাকবার এই চলমান সংকটকে দীর্ঘায়িত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে রেজোলিউশন ১৯৪ পাস করে শরণার্থীদের ফেরার অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেও, এটি বাস্তবায়নের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ইসরায়েল এই রেজোলিউশন মানতে অস্বীকার করেছে, এবং পশ্চিমা শক্তি—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র—ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন দিয়ে এই অস্বীকৃতিকে সমর্থন করেছে।
২০২৫ সালে এই নিষ্ক্রিয়তা আরও স্পষ্ট। গাজায় অবরোধের ১৮তম বছরে UNRWA-এর তহবিল সংকট তীব্র হয়েছে, কারণ অনেক পশ্চিমা দেশ তাদের অর্থায়ন কমিয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনৈতিক সমর্থন ইসরায়েলি নীতিকে উৎসাহিত করছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযানের সময় জাতিসংঘে একটি নিন্দা প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোতে বাতিল হয়।
এই নিষ্ক্রিয়তার পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থ ও ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখে, যা ফিলিস্তিনি দাবির প্রতি তাদের উদাসীনতার কারণ। এদিকে, আরব দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব এবং অভ্যন্তরীণ সংকট (যেমন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ) ফিলিস্তিনি সংগ্রামের প্রতি তাদের সমর্থন কমিয়েছে। ফলে, ফিলিস্তিনিরা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, এবং নাকবার সমাধান আরও দূরবর্তী হয়ে গেছে।
নাকবা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান। এটি ১৯৪৮ সালে শুরু হয়ে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলমান থাকার মাধ্যমে প্রমাণ করে যে ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি একটি সময়-সীমাবদ্ধ ঘটনা নয়, বরং একটি ধারাবাহিক অবিচার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা এই প্রক্রিয়াকে শুধু দীর্ঘায়িতই করেনি, বরং ইসরায়েলি নীতির প্রতি একটি নীরব সম্মতি প্রদান করেছে।
এই বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে নাকবা ফিলিস্তিনিদের জন্য অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎকে সংযুক্ত করে। এটি তাদের প্রতিরোধের প্রেরণা এবং তাদের দুর্দশার প্রতীক। যতক্ষণ না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই অবিচারের সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, ততক্ষণ নাকবা ফিলিস্তিনি জীবনের একটি অপরিহার্য বাস্তবতা হয়ে থাকবে।
৯. উপসংহার
২০২৫ সালে নাকবা তার ৭৭তম বছরে পৌঁছেছে, এবং ফিলিস্তিনি জনগণ এখনো ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া এই বিপর্যয় শুধু একটি অতীতের ঘটনা নয়, বরং একটি জীবন্ত বাস্তবতা যা ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে চলেছে। এই গবেষণা প্রমাণ করে যে নাকবা কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়; এটি অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎকে সংযুক্ত করে একটি চলমান প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা এই অবিচারকে দীর্ঘায়িত করলেও, ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ এবং তাদের স্বাধীনতার দাবি অটুট রয়েছে। এই উপসংহারে নাকবার তাৎপর্য, এর ধারাবাহিকতা, এবং সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
৯.১ নাকবার ৭৭তম বছর: ন্যায়বিচারের অপেক্ষা
২০২৫ সালে, নাকবার ৭৭ বছর পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্মভূমিতে ফেরার, তাদের সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার, এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকারের জন্য এখনো অপেক্ষমাণ। ১৯৪৮ সালে ৭৫০,০০০ মানুষের উচ্ছেদ এবং ৫.৮ মিলিয়ন শরণার্থীর বর্তমান অবস্থা (UNRWA, ২০২৫) দেখায় যে এই সংকট সময়ের সাথে হ্রাস পায়নি, বরং তীব্রতর হয়েছে। গাজায় অবরোধ, পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযান, এবং জেরুজালেমে বাড়ি ভাঙার মতো ঘটনা (২০২৫ সালে ১০,০০০ গাজাবাসী, ৩৫,০০০ পশ্চিম তীরবাসী, এবং ৫০০ জেরুজালেমের পরিবার বাস্তুচ্যুত) প্রমাণ করে যে নাকবা একটি সমাপ্ত অধ্যায় নয়।
ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যায়বিচারের অর্থ শুধু অতীতের ক্ষতিপূরণ নয়, বর্তমানের অবিচারের সমাপ্তি এবং ভবিষ্যতে তাদের অধিকারের স্বীকৃতি। জাতিসংঘের রেজোলিউশন ১৯৪ (১৯৪৮) শরণার্থীদের ফেরার অধিকার নিশ্চিত করলেও, ৭৭ বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এই দীর্ঘ অপেক্ষা ফিলিস্তিনিদের মনে হতাশা এবং প্রতিরোধের একটি জটিল মিশ্রণ তৈরি করেছে। তবুও, তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে, যা নাকবাকে তাদের জাতীয় পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছে।
৯.২ নাকবা: একটি জীবন্ত বাস্তবতা
এই গবেষণা দেখায় যে নাকবা ফিলিস্তিনিদের জীবনে একটি জীবন্ত বাস্তবতা হিসেবে বিদ্যমান। ১৯৪৮ সালের ঐতিহাসিক পটভূমি (ইহুদি অভিবাসন, জায়নবাদী সশস্ত্রীকরণ, ফিলিস্তিনি দমন) থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের চলমান নাকবা (গাজার অবরোধ, পশ্চিম তীরের স্থানচ্যুতি, জেরুজালেমের উচ্ছেদ) পর্যন্ত—এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা (মুহাম্মদ হাল্লাজ, ঘাদা কারমি, ইলিয়াস স্রুজি, উম জাবর উইশাহ) এবং ঐতিহাসিক বিতর্ক (ওয়ালিদ খালিদি, ইলান পাপ্পে, আভি শ্লাইম) এই সত্যকে আরও স্পষ্ট করে যে নাকবা শুধু অতীতের একটি স্মৃতি নয়, বর্তমানের একটি দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা।
নাকবা ইতিহাস, বর্তমান, এবং ভবিষৎকে সংযুক্ত করে।
- ইতিহাস: ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ৭৮% ভূমি হারানো এবং ৫৩০টি গ্রাম ধ্বংস তাদের জাতীয়তার ভিত্তি কেড়ে নেয়।
- বর্তমান: ২০২৫ সালে ৫.৮ মিলিয়ন শরণার্থী, গাজায় খাদ্য সংকট, এবং পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে রেখেছে।
- ভবিষ্যৎ: আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাব এবং ইসরায়েলি নীতির ধারাবাহিকতা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার সম্ভাবনাকে দূরবর্তী করে তুলেছে।
এই ত্রিমাত্রিক সংযোগ নাকবাকে একটি জীবন্ত বাস্তবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য কেবল ক্ষতি নয়, একটি অব্যাহত সংগ্রামের প্রতীক।
৯.৩ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই অবিচারের সমাধানে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া। ১৯৪৮ সাল থেকে জাতিসংঘের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফেরার অধিকার বাস্তবায়িত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর ইসরায়েলের প্রতি রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন, যেমন ২০২৫ সালে জাতিসংঘে নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো, এই সংকটকে দীর্ঘায়িত করেছে। UNRWA-এর তহবিল হ্রাস এবং আরব দেশগুলোর ঐক্যের অভাবও ফিলিস্তিনিদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
এই নিষ্ক্রিয়তা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি গভীর বার্তা বহন করে: তাদের ন্যায়বিচার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকার নয়। তবে, এই গবেষণা যুক্তি দেয় যে নাকবার সমাধান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি অসম্ভব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত:
- রেজোলিউশন বাস্তবায়ন: শরণার্থীদের ফেরার অধিকার (রেজোলিউশন ১৯৪) কার্যকর করা।
- মানবিক সহায়তা: গাজায় অবরোধ তুলে এবং UNRWA-কে পর্যাপ্ত তহবিল দিয়ে সহায়তা বাড়ানো।
- রাজনৈতিক চাপ: ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণ ও উচ্ছেদ নীতির বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ।
এই পদক্ষেপগুলো নাকবার চলমান প্রভাব কমাতে এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
২০২৫ সালে নাকবার ৭৭তম বছরে, এই গবেষণা প্রমাণ করে যে নাকবা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে অনেক বেশি—এটি তাদের জীবনের একটি কেন্দ্রীয় সত্য। এটি তাদের ইতিহাসের ক্ষত, বর্তমানের সংগ্রাম, এবং ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষাকে একত্রিত করে। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ এবং তাদের অধিকারের দাবি এই নাকবার মধ্যেও তাদের আশাকে জীবিত রেখেছে। তবে, এই আশার পূর্ণতা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয়তার ওপর। নাকবার সমাধান না হলে, ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যায়বিচার এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি একটি দূর স্বপ্ন হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র:
- Middle East Eye, "Nakba: The Palestinian Catastrophe, Explained,"
- Journal of Palestine Studies, "Recollections of the Nakba Through a Teenager’s Eyes," Muhammad Hallaj।
- Pappe, Ilan, "The 1948 Ethnic Cleansing of Palestine"।
- Khalidi, Walid, "Plan Dalet: Master Plan for the Conquest of Palestine"। (Journal of Palestine Studies)
- UNRWA, "Gaza Update," X পোস্ট, ১৯ মার্চ, ২০২৫।
- Al Jazeera, "West Bank Raids Displace Thousands," ১৫ মার্চ, ২০২৫।