সুনীতা উইলিয়ামস এবং ব্যারি “বুচ” উইলমোরের মহাকাশ যাত্রা শুধু একটি অভিযানের গল্প নয়, এটি প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা, মানব দেহের সহনশীলতা এবং অদম্য মনোবলের এক মহাকাব্য। এই দুই মহাকাশচারী ২০২৪ সালের জুন মাসে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা প্রায় ৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলার পর ২০২৫ সালের ১৯ মার্চ পৃথিবীতে ফিরে আসে।
![]() |
© dailypioneer.com |
যাত্রার প্রেক্ষাপট ও প্রস্তুতি
২০২৪ সালের ৫ জুন, ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল স্পেস ফোর্স স্টেশন থেকে বোয়িংয়ের স্টারলাইনার মহাকাশযানে চড়ে সুনীতা উইলিয়ামস এবং ব্যারি উইলমোর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (ISS) উদ্দেশে রওনা দেন। এটি ছিল “ক্রু ফ্লাইট টেস্ট” (CFT) নামে পরিচিত একটি মিশন, যার মাধ্যমে বোয়িং প্রথমবারের মতো মানুষকে মহাকাশে পাঠাচ্ছিল। নাসার বাণিজ্যিক ক্রু প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল স্টারলাইনারের নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা, যাতে এটি ভবিষ্যতে নিয়মিত ISS মিশনের জন্য ব্যবহার করা যায়।
সুনীতা উইলিয়ামস একজন অভিজ্ঞ মহাকাশচারী। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই আমেরিকান নারী ২০০৬-০৭ সালে এবং ২০১২ সালে দুটি দীর্ঘ মিশনে ISS-এ কাটিয়েছেন মোট ৩২২ দিন। তিনি ৭টি স্পেসওয়াক সম্পন্ন করেছেন এবং মহাকাশে মোট ৫০ ঘণ্টারও বেশি সময় কাটিয়েছেন। তার অভিজ্ঞতা এবং শান্ত মনোভাব তাকে এই মিশনের জন্য আদর্শ প্রার্থী করে তুলেছিল। অন্যদিকে, ব্যারি উইলমোর, যিনি “বুচ” নামে পরিচিত, একজন প্রাক্তন টেস্ট পাইলট এবং মার্কিন নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন। তিনি ২০০৯ সালে স্পেস শাটল মিশন STS-129 এবং ২০১৪-১৫ সালে ISS-এ একটি ৫ মাসের মিশনে অংশ নিয়েছিলেন। তার প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এই মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মিশনের পরিকল্পনা ছিল সহজ: ৮ দিন ISS-এ কাটিয়ে ফিরে আসা। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নেয়নি।
প্রযুক্তিগত জটিলতা: যখন পরিকল্পনা বদলে যায়
স্টারলাইনার ৬ জুন ISS-এ পৌঁছানোর পরই প্রকৌশলীরা লক্ষ্য করেন যে, মহাকাশযানের থ্রাস্টার সিস্টেমে সমস্যা রয়েছে। এই থ্রাস্টারগুলো মহাকাশযানের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ এবং ISS-এর সঙ্গে ডকিংয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৮টি থ্রাস্টারের মধ্যে ৫টি বিকল হয়ে যায়, এবং পরে আরও একটি সমস্যা ধরা পড়ে—হিলিয়াম লিক। হিলিয়াম গ্যাস থ্রাস্টারের জ্বালানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হয়, এবং এই লিকের ফলে সিস্টেমের চাপ কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
নাসা এবং বোয়িং প্রথমে ভেবেছিল এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা যাবে। কিন্তু পৃথিবীতে গ্রাউন্ড টেস্টিং এবং ডেটা বিশ্লেষণের পর দেখা গেল, থ্রাস্টারের সিলিংয়ে তাপ-সম্পর্কিত ত্রুটি রয়েছে, যা ফিরতি যাত্রায় বিপজ্জনক হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নাসা একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়: সুনীতা এবং বুচকে স্টারলাইনারে ফিরিয়ে না এনে ISS-এ রেখে দেওয়া হবে। পরিবর্তে, স্পেসএক্সের ক্রু ড্রাগন মহাকাশযান তাদের ফিরিয়ে আনবে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে তাদের মিশনের সময়সীমা বেড়ে যায় প্রায় ২৮৬ দিনে। স্টারলাইনার নিজে ২০২৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পৃথিবীতে ফিরে আসে, কিন্তু তাতে কোনো ক্রু ছিল না। এটি বোয়িংয়ের জন্য একটি বড় ধাক্কা হলেও নাসার দ্রুত বিকল্প পরিকল্পনা তাদের খ্যাতি রক্ষা করে। সুনীতা এবং বুচকে তখন ক্রু-৯ মিশনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যারা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ISS-এ পৌঁছায়।
মহাকাশে জীবন: শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জ
ISS-এ প্রায় ৯ মাস কাটানো সুনীতা এবং বুচের জন্য সহজ ছিল না। শূন্য মাধ্যাকর্ষণের পরিবেশে দীর্ঘ সময় থাকার ফলে শরীর ও মনের ওপর বড় প্রভাব পড়ে।
- শারীরিক প্রভাব:
মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে হাড়ের ঘনত্ব প্রতি মাসে ১-২% কমে যায়, এবং পেশির শক্তি হ্রাস পায়। এটি মোকাবেলায় তারা প্রতিদিন ২ ঘণ্টা ব্যায়াম করতেন। ISS-এর ট্রেডমিলে দৌড়ানো, সাইকেল চালানো এবং রেজিস্ট্যান্স মেশিনে কাজ করা তাদের রুটিনের অংশ ছিল। তবুও এত দীর্ঘ সময় মহাকাশে থাকার ফলে তাদের হাড় ও পেশিতে কিছুটা ক্ষয় হয়েছিল। এছাড়া, রক্ত সঞ্চালনের পরিবর্তনের কারণে শরীরের তরল উপরের দিকে চলে যায়, যা মুখ ফুলে যাওয়া এবং দৃষ্টিশক্তিতে প্রভাব ফেলতে পারে। - মানসিক চাপ:
পরিবার থেকে দূরে থাকা এবং কবে ফিরতে পারবেন তার অনিশ্চয়তা তাদের মানসিকভাবে চাপে ফেলেছিল। সুনীতা একবার বলেছিলেন, “পৃথিবীকে জানালা দিয়ে দেখা যায়, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর কোনো নিশ্চয়তা নেই—এটা মাঝে মাঝে হতাশার জন্ম দেয়।” তবে তারা ভিডিও কলের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সুনীতা তার কুকুরের সঙ্গে কথা বলে এবং বুচ তার সন্তানদের গল্প শুনে মানসিক শক্তি অর্জন করতেন। - কাজের দায়িত্ব:
তারা ISS-এ থাকাকালীন নিষ্ক্রিয় ছিলেন না। তারা সৌরশক্তি নিয়ে গবেষণা, মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে উদ্ভিদ চাষের পরীক্ষা এবং মানবদেহে শূন্য মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন। এছাড়া ISS-এর রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন—যেমন এয়ার ফিল্টার পরিবর্তন, জল পুনর্ব্যবহার সিস্টেম মেরামত এবং সৌর প্যানেল পরিদর্শন। যখন ক্রু-৯ এর সদস্যরা এসে পৌঁছান, তাদের সঙ্গে মিলে তারা আরও জটিল কাজ সম্পন্ন করেন।
পৃথিবীতে ফিরে আসা: একটি নাটকীয় প্রত্যাবর্তন
দীর্ঘ অপেক্ষার পর, ২০২৫ সালের মার্চে তাদের ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। স্পেসএক্সের ক্রু-৯ মিশনের ড্রাগন মহাকাশযানে চড়ে সুনীতা এবং বুচ, সঙ্গে নাসার নিক হগ এবং রাশিয়ার আলেকজান্ডার গর্বুনভ, ১৮ মার্চ ISS থেকে পৃথিবীর উদ্দেশে রওনা দেন।
১৯ মার্চ, ভারতীয় সময় ভোর ৩টা ২৭ মিনিটে (ইউএস সময় ১৮ মার্চ রাত ৫টা ৫৭ মিনিট EDT) তাদের মহাকাশযান ফ্লোরিডার গাল্ফ অফ মেক্সিকোয় সফলভাবে স্প্ল্যাশডাউন করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় ড্রাগন ক্যাপসুলটি প্রায় ৩,০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (১,৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা সহ্য করে। এই সময় ক্যাপসুলের তাপ ঢাল গলে যাওয়া শুরু করে, কিন্তু এটি ক্রুকে নিরাপদ রাখে। চারটি প্যারাশুট খুলে যাওয়ার পর ক্যাপসুলটি সমুদ্রে নরমভাবে অবতরণ করে।
স্পেসএক্স এবং মার্কিন নৌসেনার উদ্ধারকারী দল দ্রুত ক্যাপসুলের কাছে পৌঁছে তাদের উদ্ধার করে। সুনীতাকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়, এবং তিনি সকলের উদ্দেশে হাত নাড়েন। বুচও সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যান। তাদের প্রথমে হেলিকপ্টারে করে কাছাকাছি একটি মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাদের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করা হয়। সুনীতার পৈতৃক গ্রাম গুজরাটের ঝুলসানে এই প্রত্যাবর্তন উদযাপন করা হয় আরতি, প্রার্থনা এবং মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে।
এই অভিযানের গুরুত্ব
এই মিশন শুধু একটি সফল প্রত্যাবর্তনের গল্প নয়, এটি ভবিষ্যতের মহাকাশ গবেষণার জন্য একটি রোডম্যাপ।
- প্রযুক্তিগত শিক্ষা:
স্টারলাইনারের ত্রুটি বোয়িংকে তাদের ডিজাইন ও টেস্টিং প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। নাসা এই ঘটনা থেকে শিখেছে যে, একাধিক ব্যাকআপ পরিকল্পনা থাকা কতটা জরুরি। এটি বাণিজ্যিক মহাকাশ প্রোগ্রামের ভবিষ্যৎ সাফল্যের জন্য পথ প্রশস্ত করবে। - দীর্ঘমেয়াদী মিশনের প্রস্তুতি:
মঙ্গল গ্রহে ২-৩ বছরের মিশন বা চাঁদে দীর্ঘমেয়াদী ঘাঁটি তৈরির জন্য এই অভিজ্ঞতা অমূল্য। মহাকাশে দীর্ঘ সময় থাকার শারীরিক ও মানসিক প্রভাব বোঝা গবেষকদের পরবর্তী পরিকল্পনায় সাহায্য করবে। - আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:
নাসা, স্পেসএক্স এবং রাশিয়ার রসকসমসের সমন্বয়ে এই মিশন সম্পন্ন হয়েছে। এটি দেখায় যে, মহাকাশ গবেষণায় দেশীয় সীমানা অতিক্রম করে একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব।
সুনীতা উইলিয়ামস এবং ব্যারি উইলমোরের এই মিশন প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তির ব্যর্থতা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও মানুষের দৃঢ়তা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যে কোনো চ্যালেঞ্জ জয় করা যায়। সুনীতা, যিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন বিশ্ব নাগরিক, এই সাফল্যে বিশ্বব্যাপী তরুণদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন। তাদের এই গল্প শুধু বিজ্ঞানের জয়গান নয়, বরং মানবতার অদম্য চেতনার এক জীবন্ত উদাহরণ। ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে পা রাখা বা চাঁদে স্থায়ী ঘাঁটি গড়ার স্বপ্ন এই ধরনের অভিযানের মাধ্যমেই বাস্তবে রূপ নেবে। Keywords: সুনীতা উইলিয়ামস, ব্যারি উইলমোর, মহাকাশ যাত্রা, সুনীতা উইলিয়ামস মহাকাশ মিশন, ব্যারি উইলমোর স্টারলাইনার, মহাকাশে ২৮৬ দিন, নাসা মহাকাশচারী প্রত্যাবর্তন, স্পেসএক্স ক্রু-৯ মিশন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, স্টারলাইনার সমস্যা, শূন্য মাধ্যাকর্ষণ, মঙ্গল গ্রহ গবেষণা, ভারতীয় মহাকাশচারী, সুনীতা উইলিয়ামস গল্প, মহাকাশ থেকে ফিরে আসা, নাসা মিশন ২০২৫, ISS-এ ৯ মাস, সুনীতা ও বুচ যাত্রা