নরওয়ে vs সাগরিকা: Journey of a Mother এর Sangram ও জয়

সাগরিকা চক্রবর্তী, একজন ভারতীয় অভিবাসী, নরওয়েতে তার স্বামী অনুরূপ ভট্টাচার্যের সঙ্গে সংসার শুরু করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার দুটি সন্তান—অভিগ্যান (২.৫ বছর) এবং ঐশ্বর্যা (৫ মাস)—ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বড় হোক। কিন্তু ২০১১ সালের মে মাসে নরওয়ের শিশু কল্যাণ সংস্থা (Barnevernet বা CWS) তার জীবনে এক অভাবনীয় বিপর্যয় ডেকে আনে। তারা সাগরিকা ও তার স্বামীর কাছ থেকে সন্তানদের হেফাজতে নিয়ে ফস্টার কেয়ারে রাখে। সাগরিকা এই ঘটনাকে "অপহরণ" হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

© amazon.com

নরওয়ের শিশু কল্যাণ সংস্থা যে কারণগুলো উল্লেখ করেছিল, তা ভারতীয়দের কাছে অবাক করার মতো। তারা বলেছিল, সাগরিকা তার সন্তানদের হাতে খাওয়ানো (যাকে তারা 'জোর করে খাওয়ানো' বলে অভিহিত করেছে), তাদের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমানো এবং তার 'মানসিক অস্থিরতা' ও 'আবেগীয় সংযোগের অভাব' সন্তানদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নয়। এই ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রথাগুলোকে তারা অপব্যাখ্যা করে এবং সাগরিকার মানসিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সাগরিকা আইনি লড়াই শুরু করেন, কিন্তু প্রথমে তিনি তার সন্তানদের ফিরে পেতে ব্যর্থ হন।

স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা ও সংগ্রামের নতুন মোড়

শুরুতে সাগরিকার স্বামী অনুরূপ তার পাশে ছিলেন। তারা একসঙ্গে ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। সাগরিকা অভিযোগ করেন যে, অনুরূপ তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছেন, সম্ভবত নরওয়ের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার জন্য। এই বিশ্বাসঘাতকতা সাগরিকার জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছিল। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। ভারত সরকারের কাছে তিনি আবেদন জানান এবং এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলোচনায় চলে আসে।

ভারতের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সন্তানদের প্রত্যাবর্তন

সাগরিকার মামলা ভারত ও নরওয়ের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণ হয়ে ওঠে। ভারত সরকারের চাপ এবং আইনি প্রক্রিয়ার ফলে ২০১২ সালের এপ্রিলে নরওয়ের আদালত সিদ্ধান্ত নেয় যে, সন্তানদের তাদের চাচা অরুণাভাস ভট্টাচার্যের হেফাজতে ভারতে পাঠানো হবে। অরুণাভাস সন্তানদের কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন। এরপর সাগরিকা ভারতীয় আদালতে নিজের জৈবিক মা হিসেবে সন্তানদের হেফাজতের জন্য আবেদন করেন।

কলকাতা হাইকোর্টে মামলার শুনানি চলে। সাগরিকা তার নরওয়ের অভিজ্ঞতা, স্বামীর নির্যাতন এবং সন্তানদের জন্য তার লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আদালত তার পক্ষে রায় দেয়। প্রায় দেড় বছরের সংগ্রামের পর তিনি তার সন্তানদের হেফাজত ফিরে পান এবং তাদের সঙ্গে পুনর্মিলন করেন।

বর্তমান জীবন ও অবদান

আজ সাগরিকা চক্রবর্তী একজন স্বাবলম্বী নারী। তিনি ইনফরমেশন টেকনোলজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং নয়ডায় আইটি ক্ষেত্রে কাজ করছেন। তার সন্তানরা, অভিগ্যান ও ঐশ্বর্যা, কলকাতার বিরাটিতে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন। সাগরিকা তার জীবনের এই অভিজ্ঞতা "Journey of a Mother: The Diplomatic War Between Norway and India" নামে একটি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। বইটি ২০২২ সালে প্রকাশিত হয় এবং এটি তার সংগ্রাম ও জয়ের গল্পকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে।

সাংস্কৃতিক সংঘাত ও শিক্ষা

সাগরিকার গল্প শুধু একজন মায়ের লড়াই নয়, এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবেরও প্রতিচ্ছবি। নরওয়ের শিশু কল্যাণ নীতি, যা পশ্চিমা জীবনধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, ভারতীয় প্রথার প্রতি সংবেদনশীলতার অভাব দেখিয়েছে। হাতে খাওয়ানো বা একসঙ্গে ঘুমানো—যা ভারতে স্নেহ ও যত্নের প্রতীক—নরওয়েতে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং অভিবাসী পরিবারগুলোর জন্য সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার গুরুত্ব তুলে ধরেছে।

সাগরিকা চক্রবর্তীর জীবন একটি অনুপ্রেরণার গল্প। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, একজন মা তার সন্তানদের জন্য কতটা লড়তে পারেন। বিদেশের মাটিতে সাংস্কৃতিক পার্থক্য, পারিবারিক বিশ্বাসঘাতকতা এবং আইনি জটিলতার মধ্যেও তিনি হার মানেননি। তার বই এবং জীবনের পথচলা আমাদের সাহস, ধৈর্য এবং ন্যায়ের জন্য লড়াই করার শিক্ষা দেয়। সাগরিকা আজ শুধু একজন মা নন, তিনি বিশ্বের অনেক অভিবাসী নারীর কণ্ঠস্বর।

Labels : #Book ,#History ,

Post a Comment